আমি নিরাপদ থাকতে চাই, নিরাপদ সড়ক চাই

672

“বর্তমান পরিস্থিতি ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান [1]”। – এই কথাটা প্রথমআলো থেকে নেয়া। এই পোষ্টে যতগুলো লিংক বা ছবি আছে সবই প্রথমআলো বা বিডিনিউজ২৪ থেকে নেয়া। সঠিক সোর্স না থাকলে আবার আমরা গুজবের পিছনে দৌড়াতে থাকি ঘটনার গুরুত্ব চিন্তা না করেই।

যাই হোক, ধৈর্য একটা খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধৈর্য বলতে কি বুঝিয়েছেন তা বুঝলাম না। দেশের ভিতরে আইন-কানুন বজায় রাখার জন্য যে ধৈর্যের সীমার পরীক্ষা দিতে হয় তা জানতাম না। আমি ভাবতাম আইন নিজের গতিতে চলে। আইনের অবনতি ঘটলে বিধীমোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হয়। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি নিজেকে চেয়ারে বসিয়ে বলেন যে ওনার ধৈর্যটাই শেষকথা তাহলে আর কিছুতো বলার নেই। আইন প্রয়োগের প্রয়োজন হলে প্রয়োগ করেন মাননীয় মন্ত্রী। ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই।

ওইদিকে সেতু-মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আবার বল প্রয়োগ করতে এলে চুমু খাবে কি খাবে না তা নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। ওনার কথা কেন উষ্কানীমূলক বলে গণ্য করা হবে না? উনি বলেছেন,  “এখন আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে গোলাগুলি করতে করতে আসবেন, তাদের কে কি বল প্রয়োগ করবে না? চুমু খাবে?” [৩]

— চুমু কেন খাবে। কার্যালয় থেকে পুলিশকে ফোন দিবে। ছবিতে দেখলাম পুলিশ ছিলোই আশে পাশে। ব্যবস্থা যা নেয়ার পুলিশ নিবে। গোলাগুলির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অফিস বল কিভাবে প্রয়োগ করবে? নাকি গোলগুলির মোকাবেলা করার মত অস্ত্র আছে অফিসে? আর মাননীয় মন্ত্রীর একই কথা কেন সাধারণ শিক্ষার্থী বা মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে না? শিক্ষার্থীদের উপরে আক্রমণ করলেও নিশ্চয়ই প্রতিহত করা উচিত তাই না (এখানে আক্রমণ তো আবার বেশি লাঠি-সোটা দিয়ে হয় যেটা খালি হাতে কিছু হলেও প্রতিহত করা সম্ভব আত্মরক্ষার জন্য)? অবশ্য তারা প্রতিহত করলেতো আবার সন্ত্রাসী বা সরকারবিরোধী হয়ে যায়।

গুজব ছড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরে কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগ অফিসে মেয়েদের নাকি আটকে রেখেছে, সাংবাদিক বন্ধুরা আপনারা আওয়ামী লীগ অফিসে সারাদিন ছিলেন, কোথায় আটকেছিল কে? অনেক ঘটনাই ফাঁস হয়ে যাবে, সবার ছবি আছে। সবার কার্যক্রম আমরা নীরবে লক্ষ করেছি।” [৩]

– সবার ছবি আছে জিনিসটা শুনে বিশ্বজিৎ হত্যার কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের দেশের আইন নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ যে হয়না তা খালি চোখেই দেখা যায়। কেউ কেউ শুধু ফেইসবুকে ২ লাইনের কিছু লিখলেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যায় এবং তার জান কাহিল হয়ে যায়। আবার অন্যদিকে অস্ত্র হাতে দেখা ছবিগুলোরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

জিগাতলা এলাকায় শনিবার শিক্ষার্থীদের ওপরে হামলাকারী একজনের পরিচয় মিলেছে। তিনজনের মধ্য পাঞ্জাবি পরা ঢিল ছুড়ে মারা মাঝখানের জনের নাম রুবেল হোসেন। তিনি বেসরকারি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছবি: প্রথম আলো [ছবিসূত্র ১]
উপরের ছবির মত অনেকগুলো ছবিও ভেসে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে এবং পত্রিকায়। নীরব না থেকে এইগুলোর জন্যও ব্যবস্থা নিন মাননীয় মন্ত্রী। আর এটাও কি কার্যালয়ে হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা? আপনার সাংবাদিক বন্ধুদের উপরেও কিন্তু আক্রমণ হচ্ছে। নীরবতা ছাড়ুন।

সবচেয়ে হতাশার হলো পুলিশ সাথে থাকলেও কোন একশনে যায় না। বসে বসে বিনা টিকিটে সিনেমা দেখে।

রোববার ধানমণ্ডি এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় এক আলোকচিত্রীকে মারধর করে একদল যুবক। [ছবিসূত্র ২]
উপরের ছবিগুলোর সাথে নিচের সংবাদটুকুও প্রকাশ করে বিডিনিউজ২৪.

এরই মধ্যে মধ্যে দুপুর ২টার দিকে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের উপর চড়াও হয় হেলমেট পরা একদল যুবক। তাদের হাতে ছিল কিরিচ, লাঠিসোঁটা। এপির আলোকচিত্র সাংবাদিক এ এম আহাদসহ কয়েকজন সাংবাদিককে মারধর করে তারা। ভাংচুর হয় তাদের ক্যামেরা। সেখানে নাগরিক টেলিভিশনের গাড়িও ভাংচুর হয়। এসময় পুলিশ থাকলেও তারা আটকায়নি এই যুবকদের। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ কর্মকর্তা মারুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা তো পুলিশের উপর হামলা চালায়নি। আর তারা কারা, আমরা তাদের চিনি না।” [৬]

পুলিশের কাজ জনগণের নিরাপত্তা দেয়া। পেশাজীবীদের নিরাপত্তা দেয়া। কিছু পুলিশও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ আইন রক্ষার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত। কিন্তু বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ বা আমরা আমাদের দেশের সিস্টেমটাকেই এতটাই খারাপ করে ফেলেছি যে পুলিশ নিজেকে রক্ষা করাটাই তাদের দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। “তারা তো পুলিশের উপরে হামলা চালায়নি” – এত বড় লেইম একটা কথা একজন কর্মকর্তা কিভাবে বলেন? তিনি আরো বলেছেন যে, “তারা কারা, আমরা তাদের চিনি না”। – পুলিশ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। শুধু পুলিশ না যে কোন মানুষই তো এগিয়ে যাওয়ার কথা অন্য একজন মানুষের উপরে কিছু গুণ্ডা হামলা করে। সেখানে পুলিশ হয়েও তারা এগিয়ে যাননি। আর আপনাদের চিনার দরকার কি? নাকি এক এক রকমের হামলা কারীদের জন্য আপনাদের ভিন্ন ভিন্ন কানুন? আগে আটকান পরে তাদের পরিচয় বের করেন। নাকি আপনাদের উপরে নিষেধ করা আছে যে না চিনলে আক্রমণ করা যাবে না? আর একটা সম্পূরক প্রশ্ন। শিক্ষার্থীরা কি আপনাদের উপরে হামলা করেছিলো?

আন্দোলন নিয়ে অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এটাকে রাজনৈতিক-রূপ দিয়ে অন্য মহল উদ্দেশ্য হাসিলেরও চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন কোন গুজব ছড়ায় যেটাতে কারো নিরাপত্তা জড়িত তখন কি করা উচিত সরকার, প্রশাসন এবং পুলিশের? হামলা, নিহত এবং ধর্ষণের সংবাদগুলোকে গুজব বলে সারাদেশে তর্কতর্কি শুরু করিয়ে দেয়া হলো। মানুষের ইমোশনের সুযোগ নেয়া হলো। এই জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কি করছিলো? আমি অনেক খুঁজেও তাদের র‍্যাপিড কোন একশনের সংবাদ পাইনি। হতাহতের কিংবা ধর্ষণের কথা বের হওয়ার পরেও আমি দেখিনি পুলিশ আওয়ামী কার্যালয়ে কিংবা যে সব জায়গায় ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ওখানে গিয়ে হানা দিয়ে মিডিয়ার সামনে সত্যি কথা তুলে ধরতে। কোন ঘটনা ছড়ালে গুজব হতেই পারে। কিন্তু যদি ১০০টা গুজবের মাঝে ১টাও সত্যি হয় তাহলেও কি আমরা বসে থাকবো গুজব কেন ছড়িয়েছে এই আলোচনায়? এই বসে থাকার স্বভাবটার জন্যই কিন্তু গুজব বেশি করে ছড়ায়। প্রয়োজন আগে ব্যবস্থা নেয়ার, এরপর যদি গুজব হয় সেটা তুলে ধরার এবং যারা গুজব ছড়ায় তাদের ধরার। হয় উল্টোটা! আগে যারা এমন সংবাদ ছড়ায় তাদের ধরা হয় এবং এরপর এটা যে গুজব তা প্রমাণ করা হয়। এরকম একটা সিস্টেমের উদ্ভাবক কে? আর আমরাও গুজব কেন ছড়াইছে এটা নিয়ে খুব ব্যস্ত। গুজব ছাড়াও যে শিক্ষার্থীর উপরে হামলা হয়েছে এবং তার ছবিসহ প্রমাণ আছে সেটা আমাদের কাছে আবার যথেষ্ট নয়।

নিরাপদ সড়ক একটা সার্বজনীন চাওয়া। সড়ক নিরাপদ হওয়ার জন্য, কিংবা পরিবহন ব্যবস্থা নিরাপদ হওয়ার জন্য আন্দোলনটাই তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের দেশটা কতটা ভুল ভাবে চলছে। রাজপথ থেকে গ্রামীণ সড়ক, সর্বত্র চলাচল করছে ফিটনেসহীন গাড়ি। দেশে ফিটনেসহীন গাড়ি পাঁচ লাখ [৭]। দেশে লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভার গাড়ি চালায়, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি রাস্তা চলে, ট্রাফিক নিয়ম না মেনেই চলে লাখ লাখ গাড়ি। এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য আইন রয়েছে। যা নেই তা হচ্ছে ওই সব আইনের প্রয়োগ। যদি কোন আইনের প্রয়োগ না থাকে তার দায়ভার কার? নিরাপদ সড়ক সবার দরকার। সরকারীদল, বিরোধীদল, জনগণ সবারই। নিজেদের অযোগ্যতা এবং দুর্নীতি ঢাকার অযথা চেষ্টা না করে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। দায়িত্বশীল জায়গায় থেকেও যদি পরিবহন মন্ত্রী তার দায় না বুজতে পারেন তাহলে ওই পদে থাকার কোন অধিকারও ওনার নেই। সমস্যার সমাধান করুন। জনগণের সরকার হোন। দেশে মানুষ ১৬ কোটিরও বেশি। সরকার এই সব মানুষেরই। কোন নির্দিষ্ট সমর্থক বা জনগোষ্ঠীর না।

তথ্য সূ্ত্র:
[1]  ধৈর্যের সীমা ছাড়ালে কাউকে ছাড় নয়: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
[2] ‘তাদের বলপ্রয়োগ না করে কি চুমু খাবে’
[৩] বল প্রয়োগ করতে এলে কি ‘চুমু’ খাবে: ওবায়দুল কাদের
[৪] ‘চুমু’ বেরিয়েছে মুখ ফসকে: কাদের
[৫] অনেক ঘটনাই ফাঁস হয়ে যাবে, সবার ছবি আছে।
[৬] তারা তো পুলিশের উপর হামলা চালায়নি। আর তারা কারা, আমরা তাদের চিনি না।
[৭] দেশে ফিটনেসহীন গাড়ি পাঁচ লাখ

ছবিসূত্র:
১. এক হামলাকারীর পরিচয় মিলেছে
২. ধানমণ্ডিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ

ফিচার ছবিসূত্র:
নিরাপদ সড়কের দাবিতে বৃষ্টিভেজা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ছবি: যুগান্তর

Comments

comments