নোরা আমার মেয়ের নাম। পুরো নাম নিয়ুশা নোরা কবির। নোরা শব্দের অর্থ সন্মানিতা, সন্মান, আলো। আমাদের কাছে নোরা হচ্ছে আলো। আলো অনেক কিছুরই হয়, অনেক রকমের হয়। নোরা আমাদের চোখের আলো। আমাদের ছোট গ্যালাক্সির ও প্রধান নক্ষত্র। অবশ্য আমার কাছে নোরার অবস্থান ভিন্নরকম। আমি ওর চোখ দিয়ে এই জগত দেখতে চাই আগামী বছরগুলোতে। আমি বাবা-মায়ের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখেছি, দেখেছি ইভার চোখ দিয়ে, ভাই, বন্ধুদের চোখ দিয়ে। সব চোখই ছিলো ফিল্টার করা। তারা যা দেখাতে চেয়েছে তাই দেখতে হয়েছে। বাবা-মা কষ্টগুলো লুকিয়ে আনন্দগুলো দেখানোর চেষ্টা করেছে। জগতের খারাপ থেকে আড়াল করে রাখার সবচেষ্টা করেছে। ইভাও চেষ্টা করেছে না-পাওয়াগুলো আড়ালে রাখতে। অনেক কিছুই হয়ত বলতে গিয়ে বলতে পারেনা। ছোটবেলার যখন ফিল্টার ছাড়া এই জগত নিজের চোখে দেখার সুযোগ ছিলো তখন কি দেখেছি কিছু মনে নেই আমার। যখন বুজতে শিখেছি ততদিনে আমার চিন্তাও বায়াসড হয়ে গেছে। আমি তখন সাদা মানে সুন্দর, কালো মানে ভীতিকর এইরকম চিন্তা মাথা নিয়ে নিয়েছি। নোরা আমাকে আগামী কয়েকটা বছরে দেখাবে পৃথিবী আসলেই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে কেমন লাগে। আমি যতটুকু পারি চেষ্টা করবো যাতে ওর চিন্তাভাবনা বায়াসড না হয়ে যায় সেই চেষ্টা করতে।
ছোটবেলায় থেকে কালো, অন্ধকারকে অশুভ বলে তুলে ধরা হয়। বাচ্চাকে বলা হয় একটু পরেই অন্ধকার নেমে যাবে। তখন বিপদ, ঘুমাতে হবে। অন্ধকার অশুভ নয়। অন্ধকার নিজে নামে না, নিজে আসে না। আলো চলে যায় দেখেই অন্ধকার হয়। আমি নোরাকে বলতে চাই অন্ধকারে ভয়ের কিছু নেই। অন্ধকারেও পৃথিবী দেখা যায়। তবে ওটা দেখার জন্য তোমার নিজের আলো থাকতে হবে। আর এইজন্যই মা তোমার নাম নোরা, তুমি আলো ♥।
ফেব্রুয়ারীর ১৩ তারিখে আমরা (আমি এবং ইভা) নিশ্চিত হই যে আমরা ৩জন হতে যাচ্ছি। ওই সময়কার অনুভূতি আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমি চেষ্টা করতে চাইও না। ওইদিন থেকেই আমার নতুন করে শেখার পর্ব শুরু হয়ে যায়। অক্টোবরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত আমি শিখতে থাকি মা-বাবা কত কষ্ট করে আমাদের এই জগতে নিয়ে আসে। কত ত্যাগ লুকিয়ে থাকে আমাদের জন্মের পিছনে। একজন হবু মা ৯টা মাস কত কষ্ট করে তা আমি যদি এত কাছ থেকে ইভাকে না দেখতাম এবং আমরা দুইজন যদি বিদেশে একা না থাকতাম তাহলে কখনও জানা হতো না। দেশে অন্য সবাই থাকার কারণে অনুধাবন করার সুযোগটাই আসতো না। প্রথম ৩ মাস না খেতে পেরে এবং বমি করে প্রায় ১৩ পাউন্ড ওজন হারায় ইভা, এরপর জোর করে খেতে খেতে এবং পরে খেতে ভালো লাগায় হুট করে জানতে পারে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, শেষের দিকে খাওয়া কমিয়ে দেয় ডায়াবেটিসের ভয়ে। পরে আমার বাচ্চার ওজন ঠিকমত বাড়ছে না শুনে ডায়াবেটিসের দিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে খেতে থাকে রাত-দিন। আর কত রাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে এবং শেষ কবে ৩-৪ ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছে তা নিশ্চিত করে ইভা বলতে পারবে না। আমি দেখে বুঝেছি আমাদের মায়েরা কত কষ্ট করেছে। আমি নিশ্চিত ওনাদের সময় সুযোগ সুবিধা আরো কম ছিলো :(।
গত ৮ মাস আমি অনেক কিছু পড়ে কাটিয়েছি। বেশিরভাগই বাচ্চা পালন, মায়ের যত্ন এইসব নিয়ে। বাংলায়ও আমি মাঝে মাঝে সার্চ দিয়েছি। ফেইসবুকেও আমি দেখার চেষ্টা করেছি। বাংলা কনটেন্ট নিয়ে আমি খুবই হতাশ। ফেইসবুক নিয়ে হতাশাটা আরো বেশি। বেশিরভাগ লিখাই অসম্পূর্ণ এবং বায়াসড। যার যার নিজের মত করে লিখা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মায়ের ডিপ্রেশন নিয়ে লিখাগুলো। লিখাগুলোর মানে এমন যে মায়েরা ডিপ্রেশনে ভুগবেই এবং বাবাদের সতর্ক ও খেয়াল রাখতে হবে যাতে না ভুগে। আমার কাছে বিষয়টা হচ্ছে গাছে উঠিতে মই কেড়ে নেয়ার মত। এইসব লিখা না পড়লে হয়ত অনেক মা বিষয়টা বুঝতই না এবং সমস্যারও কিছু ছিলো না। এখন সমস্যাটা জানে, কিনা জানেনা সমাধান কি। বাবা জানেনা তাকে ঠিক কিভাবে ডিপ্রেশন দূর করায় সহায়তা করতে হবে। আবার মায়েরাও জানেনা যে আসলে কোনটা মন খারাপ এবং কোনটা ডিপ্রেশন। আমার কথা সিম্পল। মাকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। নিয়মিত ঘুরতে যান, গল্প করুন, বাইরে খেতে যান। রাতে ঘুম ভাঙলে তাকে ধরে উঠে দিন। তাকে কিছু একটা বানিয়ে খাওয়ান। তাকে বুঝান যে সে স্পেশাল কেউ। তাকে বুঝতে দিন যে তার এই ৯টা মাস স্পেশাল। জীবনে এই ৯মাস আবার নাও পেতে পারে। নিজের ভিতরে আর একটা মানুষকে অনুভব করা সাধারণ কথা নয়। আমরা পুরুষরা এই অনুভূতি কখনও পাবো না। তাকে বই পড়তে দিন। তাকে বাচ্চার যত্ন নেয়ার জন্য নানান আর্টিকেল এবং লিখা পড়ান। আর যদি পারেন ফেইসবুক নামক আপদ থেকে দূরে রাখুন। এরপরেও অনেক হতভাগা মা আছেন যাদের দেখার কেউ নেই। আমি জানিনা তারা কিভাবে এই সময়টা পার করেন :(। আমি চাই মায়েদের এই সময়টা অন্যরকম কাটুক। মা হিসেবে গর্ব করে কাটুক।
সন্তান হওয়ার পরে ছেলেদের নাকি আবার নতুন করে জন্ম হয়। কথাটা একদমই সত্যি। নিজের দিকে তাকিয়ে আমারই অবাক লাগে। নিজেকে নিয়ে অনেক কিছুই আমার জানা ছিলো না। জানা ছিলোনা যে, আমি নিজের আম্মাকে আসলে এই জীবনে তেমন কিছুই বুঝতে পারিনি। এখন আমার ২টা মা। একজন যে আমাকে জন্ম দিয়েছেন, এই পৃথিবীকে চিনিয়েছেন। অন্যজন যে আমার ঘরে আলো হয়ে এসেছে আমাকে নতুন করে জগতকে দেখাবে। সে আমাকে শিখিয়েছে নিজের মা কে কিভাবে আসলে বোঝা উচিত। অন্তত এইটুকুর জন্য হলেও ছোট্ট নোরার প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
সন্তান পালন অবশ্যই অনেক কঠিন একটা দায়িত্বও কাজ। কেউ নিশ্চিতভাবে জানেনা কিভাবে লালন-পালন করলে কোন বাচ্চার কেমন হবে। আমি জানিনা কোনটা করা ঠিক হবে, কোনটা করা ভুল হবে। তবে আমি চাই মেয়ে সব মানুষকে সমানভাবে দেখবে। ধনী এবং গরিবের মাঝে পার্থক্য একটা বাচ্চা জানেনা, বাচ্চারা জানেনা কদাকার মানে কি, বাচ্চারা জানেনা সাদা চামড়ার এবং কালো চামড়ার মাঝে আলাদা কিছু আছে কিনা। ওইসব আমরা বুড়োরা জানি। আমরা বাচ্চাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেই যত্ন করে। আমরা বলি ওর কোলে দিও না ভয় পাবে। বাচ্চারা চেহারা দেখে ভয় পায় না। ওদের মন এমন ছোট না। ওরা যা দেখে তাই স্বাভাবিক মনে করে। সমস্যাগুলো আমাদের। আমি চাই আমাদের মেয়ে এই সমস্যাগুলো থেকে দূরে থাকুক। আমি চাই মেয়ে নিজের চেহারার সাথে অন্য কাউকে তুলনা করে কষ্ট বা আনন্দ না পাক। আমি নোরার ছোট চোখগুলোতে সব মানুষের জন্য একই রকম আবেগ, মুগ্ধতা দেখতে চাই। মেয়েকে বড় করার সময় এটাই থাকবে মূল লক্ষ্য।
আর নোরাকে আমি ৩টা কথা দিতে চাই। প্রথমত, আমি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মায়েদের নিরাপদ এবং আনন্দময় মাতৃত্বের জন্য কিছু কাজ করবো। দ্বিতীয়ত, আমি তোমার যেভাবে খেয়াল রাখবো আগামী দিনগুলোতে তোমার দাদুরও একইভাবে খেয়াল রাখবো। সবশেষে, আমি তোমার উপরে কখনও কিছু চাপিয়ে দিবো না। ছায়া হয়ে আমি তোমার পাশে থাকবো কিন্তু কখনও তোমার জীবনের মেঘ হতে চাইনা।
ছবিটা আমাদের ৩ জনের। ইভা, নোরা এবং আমি। সবার কাছে আমরা দোয়া চাই। দোয়া করবেন আমাদের মেয়েটা যাতে একজন সত্যিকারের মানুষ হয়। আমাদের মেয়েটা যাতে নিজের নাম স্বার্থক করে অন্ধকার দূর করে আলো এনে দিতে পারে। 🙂