বর্তমানে দেশে যে কোটা আন্দোলন হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অদ্ভুত মনে হয় আমার। অদ্ভুত মনে হওয়া কারণ ২টি। প্রথমত, যারা আন্দোলন করছে তাদের একটা অংশ এমনভাবে কথা বলছে যে এটা মায়ের কাছে আবদার বা দাবী। মা ভালো মনে হলে দাবী মানবেন নয়ত মানবেন না। দ্বিতীয়ত, সরকার এবং একটা মহল এমন আচরণ করছে যে তারা কোনভাবেই এই আন্দোলনের পিছে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না এবং এটাকে শুধুমাত্র একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। এই আন্দোলন কেনো গুরুত্বপূর্ণ তা লিখে শেষ করা যাবে না। তবে খালি চোখেই যে কোনো ছাত্র আন্দোলনই খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই পৃথিবীতে। আর আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসও অনেক ব্যাপক।
বর্তমানে সরকারি চাকুরীতে ৫৬ ভাগ কোটা। এই কোটা নানানভাবে বিভক্ত। তবে বড় একটা অংশ হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, বেশিরভাগ আন্দোলনকারীর ক্ষোভ মূলত এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। সরাসরি বলতে না পারলেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার চাচ্ছে আন্দোলনকারীরা। আর এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রী সংসদে মুক্তিযোদ্ধা কোটাতে হাত দেয়া যাবেনা বলার সাথে সাথেই।
বিশ্বের যে কোন দেশেই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বা তাদের পরিবারের জন্য কিছু আলাদা সুযোগ সুবিধা থাকে। সেই তুলনায় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের জন্য সুযোগ সুবিধা আমাদের দেশে অনেক কম বলেই আমার মনে হয়েছে (যদিও তাদের অবদান সামরিক বাহিনী থেকে বেশি)। আর যেভাবে সুযোগ সুবিধে দেয়া হচ্ছে তাও আমার কাছে যথাযথ মনে হয়না। সরকারি চাকুরীতে যে কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা ঠিক কতটুকু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানজনক এবং তারা এ থেকে ঠিক কতটুকু উপকৃত হচ্ছেন তা আমি নিশ্চিত নই। আমার মতে কোটা সংস্কারের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়টাও সংস্কার করা প্রয়োজন। চাকুরীর বিষয়টা সব মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সমান সুযোগ দেয় না। যেমন, যাদের কোন সন্তান নেই তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমার মতে মুক্তিযোদ্ধাদের এককালীন অর্থ সুবিধা দেয়া উচিত অথবা তাদের মাসিক ভাতা সম্মানজনক-ভাবে বৃদ্ধি করা উচিত। এর সাথে সাথে তাদের পরিবার বা সন্তানদের যোগ্যতা সাপেক্ষে বিনামূল্যে শিক্ষা-সুবিধা প্রদান করা উচিত। একটি বিষয় আমি নিশ্চিত নই। আমি যতটুকু জানি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য বিশেষ কোন সুবিধে নেই। আমার মতে যোগ্যতা সাপেক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে শিক্ষা সুবিধা দেয়া আবশ্যক। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান দেশের সকল প্রতিষ্ঠানই ভোগ করছে এবং সবারই এগিয়ে আসা কর্তব্য। মূল কথা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার যাতে শিক্ষিত এবং যোগ্য হতে পারে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আমি নিশ্চিত যে বেশিরভাগ আন্দোলকারীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে চায় এবং তাদের জন্য কিছু করা হোক এটি চায়।
কিন্তু আন্দোলনের বিষয়টা হচ্ছে চাকুরী নিয়ে। চাকুরীতে আলাদা একটা কোটা নির্ধারণ করে দেয়া নিয়ে। অদ্ভুত বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের এই দাবীটা যৌক্তিক কিনা তা নিয়ে সরকার স্পষ্ট করে কোন মতামত দিচ্ছে না। বিভিন্ন মহল এই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করার চেষ্টায় আছেন। অনেকেই আবার বলছেন এই আন্দোলনকে বিএনপি, জামায়াত ব্যবহার করছে। এটা থেকে ইস্যু বের করে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার ইস্যু বের করার সুযোগ না দিলেই পারে। কোটা সংস্কারের দাবী যদি সরকার যৌক্তিক মনে না করে, তাহলে “কেন যৌক্তিক না” – তা নিয়ে বিবৃতি দিতে পারে। বিবৃতি যৌক্তিক হলে শিক্ষার্থীরা নিশ্চয় মেনে নিবে। এরপরেও মেনে না নিলে তখন সরকার এটাকে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কোটা সংস্কার করা প্রয়োজন। কোটা সংস্কারের সাথে সাথে যাদের জন্য কোটা রয়েছে তারা যাতে কোটা ছাড়াই চাকুরী পেতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। চাকুরীরে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। তার জন্য একটা মাপকাঠি থাকা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট করে দেয়া কোটা নয়। কোন পদে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং একজন সাধারণ ঘরের সন্তান যদি সমান যোগ্য হয় তখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে অগ্রাধিকার দেয়া হোক। মনে রাখা দরকার যে এখন যারা প্রার্থী এদের কারো সুযোগ ছিলোনা নিজ থেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সন্তান হওয়ার। এরা এ দেশের মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই মাটিতেই বড় হয়েছে। আমি চাই মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান এবং তাদের পরিবার যাতে পর্যাপ্ত শিক্ষা সুবিধা পায় তা নিশ্চিত হোক। অন্যদের থেকে শিক্ষার জন্য বাড়তি সুবিধা পাওয়ার পরে চাকুরীটা নিজে অর্জন করুক। কেউ না বলুক যে কোটা থাকায় চাকুরী হয়েছে। আর একই সাথে চাকুরীতে প্রতিযোগিতা হোক মেধার। কারণ যারা প্রতিযোগী সবাই যুদ্ধ পরবর্তী এই দেশে জন্ম গ্রহণ করেছে এবং এই দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছে।
কোটা নিয়ে আমার কথা শেষ। কিন্তু আরো কয়েটি বিষয় নিয়ে কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সংসদে ভাষণে কোটা নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় রয়েছে বলেছেন তিনি। তবে তিনি এর সাথে আরো অনেকগুলো কথা বলেছেন যেগুলো ঠিকমত হজম করা যায় না।
“সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে এবং কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলার অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদেরকে আন্দোলন হলেও ছাড়া হবে না বলে জানিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।” – এই কথাটি কালের কন্ঠ থেকে নেয়া। লিংক হলো http://www.kalerkantho.com/online/national/2018/07/12/657221। আমার প্রশ্ন হলো, যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের ছাড়া হবে কি হবেনা এই সিদ্ধান্ত কি প্রধানমন্ত্রী নিবেন নাকি হাইকোর্ট নিবে?
“তিনি বলেন, ‘ক্যামেরা দেখে একটা একটা করে খুঁজে বের করা হচ্ছে। ভিসির বাড়িতে যারা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ করেছে, আক্রমণ করেছে, তাদের তো ছাড়া হবে না। তাদের ছাড়া যায় না। তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তদন্ত করা হচ্ছে। অনেকে স্বীকারও করছে।’
‘যত আন্দোলনই হোক না কেন এদের ছাড়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। কারণ এরা লেখাপড়া শিখতে আসেনি।’
সংসদে এদিনের অধিবেশনে কোটা আন্দোলনকারীদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘বিরোধী দলীয় নেতা বলেছেন ছেলেপুলে আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু ভিসির বাড়িতে আক্রমণ করে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, গাড়িতে আগুন দিয়ে পোড়ানো, বাড়ি ভাংচুর করা, বেডরুম পর্যন্ত পৌছে ভাংচুর এবং লুটপাট করা, আলমারি ভেঙে গহনাঘাটি, টাকাপয়সা সব কিছু লুটপাট করেছে। ভিসির পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাচিয়েছে।’
– উপরের কথাগুলোও কালের কণ্ঠ থেকেই নেয়া। আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ স্পষ্ট। কিন্তু ক্ষোভ থাকলেও উনি দেশের সবারই প্রধানমন্ত্রী। আন্দোলনকারীরে উপরের যে হামলা হয়েছে তা নিয়ে উনি কিছু বলেননি। বরং ওনার ভাষণে ওদেরকে ব্যঙ্গ করেছেন। সরকার কোটা সংস্কার না চাইলে তা নিয়ে যুক্তি তুলে ধরতে পারে, কোটার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারে। কিন্তু যারা কোটা সংস্কার চাইছে তাদের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্বও সরকারের। তাদের উপরে হওয়া অন্যায়ের বিচারের দায়িত্বও সরকারেরই। সরকার কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নয়, সরকার সবার। সবার জন্য সুবিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করা গেলে ভোগান্তিটা সবাইকেই পোহাতে হবে আগে কিংবা পরে।